পূর্ব বিরোধের জেরে হামলা-লুট, আতঙ্কে এলাকাছাড়া সাধারণ
ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পরপরই অস্থিরতা তৈরিতে মাঠে নেমেছে বরিশালের সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। মাঠ প্রশাসন না থাকায় বিভিন্ন স্থানে হামলা, ডাকাতি, লুটপাট করার খবর পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পূর্ব বিরোধের জের ধরে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে নেমেছে ওই গোষ্ঠী। এতে করে এলাকায় এলাকায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন।
দিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আগে বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি ও টার্গেট হামলা ঠেকাতে কাজ করছে ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলো। দিনে-রাতে উভয় সময়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নিরাপত্তা দিলেও আতঙ্ক কমছে না। এদিকে ছাত্র জনতার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মাঠ প্রশাসনে। সহাবস্থান নিশ্চিতে জেলায় জেলায় বিশিষ্টজন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র প্রতিনিধির সাথে শুরু হয়েছে বৈঠক। প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগের ঘটনার খবর ছড়িয়ে পরার পরপরই বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় সড়কে সাধারণ মানুষ নেমে এসে উল্লাস করতে থাকে। এই সময়ে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা যেমন ভাঙচুর করা হয়, তেমনি বিভিন্ন এলাকায় টার্গেট ব্যক্তিদের ওপর হামলা, বাড়িঘরে লুটপাট শুরু করে একশ্রেণির সুবিধাভোগী। দোকান দখল, জমি দখল, ঘাট ও বাজার দখলের মতো ঘটনা ঘটতে শুরু করে।
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলা সদরের বাসিন্দা চৈতী কুন্ডু বলেন, সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার কিছু লোক আমাদের বসতঘরে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটতরাজ করে। ঘরে যা কিছু ছিল সব নিয়ে যায়। নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, আসবাবপত্র নিয়ে যায়। আমার মা-বাবা ভয়াবহতা দেখে আত্মগোপনে গিয়ে প্রাণ রক্ষা পায়।
তিনি বলেন, আমি ঢাকাতে ছিলাম এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন ছিল। আন্দোলনের মাঠেও ছিলাম। তারপরও রাজনৈতিক কিছু লোক আমাদের বাড়িতে লুটপাট চালায়। বরিশাল প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসেন বলেন, গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় একটি গ্রুপ ইউরো কনভেনশন হল ও ইউরো ক্যাফে নামে আমার দুটি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালায়। তারা আমার বাসায়ও হামলা চালাতে আসে। যারা হামলা করেছে তারা আমার একটি মামলার আসামি। তিনি বলেন, হামলা-লুটপাটে পূর্ববিরোধের জের রয়েছে। এরসঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আগে যার সাথে যে বিরোধ ছিল সেই শোধ নিতে টার্গেট হামলা করা হচ্ছে।
বেশ কয়েকটি লুটপাটের ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন একজন সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি বলেন, বরিশাল ক্লাব লুট, বরিশাল প্রেস ক্লাবে হামলা, বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটিতে হামলার ঘটনা দেখেছি। এসব প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থের। সব আমলেই প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হামলায় উসকানিদাতারা এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে পূর্ব বিরোধে জড়িত। তিনি আরও বলেন, এছাড়া এনেক্স ভবনে আগুন ও মালামাল লুটপাট যারা করেছেন তারা সাধারণ ছাত্র নন। বয়স্ক ও এলাকার কিছু চিহ্নিত লোক মালামাল লুটপাট করেছে। বরিশাল শহর, লাগোয়া উপজেলা শহর ও অন্যান্য জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই নয় হামলা, মারধরের ভয়ে অনেক সাধারণ মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলার রুস্তুম খাঁ বলেন, পাশের বাড়ির এক লোকের সঙ্গে আমার জমি নিয়ে বিরোধ। আমি এলাকায় জাতীয় পার্টির রাজনীতি করি। সরকার পতনের পর ওইদিন সন্ধ্যায় দখলকারীরা বাসায় এসে হুমকি দিয়ে গেছে জমি লিখে না দিলে লাশ ফেলে দেবে। আমি ভয়ে বাকেরগঞ্জে এক আত্মীয়র বাসায় এসে পরিবারসহ আত্মগোপন করেছি। ভোলা ভেলুমিয়ার বাসিন্দা
রাজ্জাক ব্যাপারী বলেন, মাছ ধরার ট্রলার আছে আমার। এলাকার একজনের সাথে এক বৎসর আগে বিরোধ হয়েছিল। সে এসে বলে গেছে ট্রলার তাকে দিয়ে দিতে। না হলে খুনখারাবি করবে। আমি ভয়ে ট্রলারসহ নদীর মাঝে তিনদিন ভেসে বেড়াচ্ছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তীরে ফিরবো। বেশ কয়েকজন সরকারি চাকরিজীবী ও পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ছাত্র-জনতার ভয় ছাড়াও এলাকার কিছু বিরোধীয় মানুষের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা আওয়ামী লীগের আমলে সেই দলের ছিল। সরকার পতনের সাথে সাথে বিএনপির লোক হয়ে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ভয় দেখাচ্ছে।
টাকাও দাবি করার খবর পাওয়া গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্মের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক সুজয় শুভ বলেন, ছাত্র আন্দোলনে অর্জিত বিজয়ের সুফল ভোগ করতে এক শ্রেণি ইতোমধ্যে নেমে পড়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে আমরা খবর পেয়েছি সংখ্যালঘু পরিবারে, উপাসনালয়ে, বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর লুটপাট করা হয়েছে। আমরাতো এমন পরিস্থিতি চাইনি। এইসব সুবিধাবাদী দুষ্কৃতকারী ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, নগরীর গড়িয়ার পার থেকে লাহারহাট পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বাস নিয়ে টহল দেই। মাইকিং করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করছি। সাধারণত রাতে টহল দেওয়া হয়। আর দিনে কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পেলে আমরা ছুটে যাই। সরকারি ব্রজমোহন কলেজ শাখার সমন্বয়ক হুজাইফা রহমান বলেন, রাতে আমরা বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিয়ে পাহারা দেই। আমাদের যানবাহন না থাকায় পায়ে হেঁটেই এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় গিয়ে মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে, এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে সংগঠিত করে ডাকাতি-লটুতরাজ প্রতিহত করতে কাজ করছি।
জেলা যুব আন্দোলনের সভাপতি এইচ এম সানাউল্লাহ বলেন, এছাড়া রাতে ডাকাতি, টার্গেট হামলা ও লুটপাট ঠেকাতে টহল দেওয়া হচ্ছে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় পাহাড়ায় নির্দিষ্ট টিম আছে। এছাড়া এলাকার নিরাপত্তায় আমাদের ওয়ার্ড কমিটি ও টহল টিম সমন্বিতভাবে কাজ করছে। যার যার অবস্থান থেকে এভাবে এগিয়ে আসায় এখন পর্যন্ত বড় কোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়নি। বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন শিকদার বলেন, লুটপাট ও ডাকাতি ঠেকাতে বিএনপির নেতাকর্মীরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া টিম নিয়ে আমরা রাতে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করি। বরগুনা জেলা পুলিশ সুপার রাফিউল আলম বলেন, একটি শঙ্কার মধ্য থেকে আমরা যাচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কবে নাগাদ মাঠে নামবে তা আমার জানা নেই।
এই বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ করলে সবচেয়ে ভালো হবে। ঝালকাঠি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আফরুজুল হক টুটুল বলেন, আমাদের পুলিশ সদস্যরা সবাই ঝালকাঠিতে আছেন। আশা করছি শুক্রবার থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা মাঠে নামব। বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি মো. ইলিয়াছ শরীফ বলেন, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছে। এ বিষয়ে গতকাল আইজিপি মহোদয় নির্দেশনা দিয়েছেন এবং পুলিশের হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনতে কাজ চলছে। নির্দেশনা
মোতাবেক পুলিশ দ্রুতই কাজে ফিরবে। এদিকে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন সক্রিয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জেলা উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা সভা করার উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক করে স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরিতে কাজ শুরু করছে। বরিশালের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা ইতোমধ্যে সবাইকে নিয়ে বসেছি। সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সকল শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে বৈঠক করেছি। সবাই আশ্বস্ত
করেছেন, আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে সবাই একযোগে কাজ করবেন।
No comments