এক মাসের কম সময় আগে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর
এক মাসের কম সময় আগে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করেছেন। সি চিন পিংয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন এবং বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারিয়ে তিনি এখন দেশছাড়া। চীনের জন্য হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি সম্ভাবনা ও শঙ্কা দুই দরজাই খুলে দিয়েছে এবং বেইজিং তা জানে। তবে দেশটি এখনো বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নিজেদের ঠোঁট চেপে রেখেছে।
হাসিনা শক্তিশালী আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে কূটনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তারপরও তাঁকে ভারতের কাছাকাছি বলে মনে করা হয়েছিল এবং সেই দেশেই তিনি পালিয়ে গেছেন। বাজপেয়ীর মতে, ‘শেখ হাসিনার বিরোধীরা সব সময়ই চীনের কাছাকাছি ছিল। এর অর্থ হলো—এই আন্দোলন চীনকে বাংলাদেশে আরও ভালো পরিস্থিতিতে এনে ফেলেছে।’
বাংলাদেশের বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর থেকে চীন সতর্কতার সঙ্গে পদচারণা করছে এবং তা অব্যাহত রেখেছে। চলতি বছরের জুলাই মাসের শুরুর দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংস্কারের দাবি তুলে এই আন্দোলন শুরু হয়। যা একপর্যায়ে শেখ হাসিনার পতনের এক দফা দাবির আন্দোলনে রূপ নেয়।
দেশে যখন আন্দোলন চলমান তখন শেখ হাসিনা চীন সফর করেন। সে সময় দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্যসহ অন্যান্য অনেক বিষয়ে। সে সময় চীন বাংলাদেশকে ১৪০ মিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা প্যাকেজও দেয় যা দুই দেশের সম্পর্কে ‘ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বে’ উন্নীত করার অংশ হিসেবে।
বাংলাদেশে আন্দোলন চলার সময় চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৯ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে জোর দিয়ে বলে, দেশটিতে যা ঘটছে তা ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’। যাই হোক, আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে গত রোববার বাংলাদেশে প্রায় একশ মানুষ নিহত হন। এর পরদিন সোমবার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই আন্দোলনকারীরা শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে হামলা চালায়।
পরদিন অর্থাৎ গত মঙ্গলবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও একটি বিবৃতি দেয় বাংলাদেশ ইস্যুতে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘চীন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ও ব্যাপক কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীন আন্তরিকভাবে আশা করে যে, বাংলাদেশে শিগগির সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আসবে।’
স্থিতিশীলতার ওপর জোর দেওয়ার বিষয়টিই মূলত চীনের প্রধান উদ্বেগকে তুলে ধরেছে। এ বিষয়ে স্টিমসন সেন্টারের চায়না প্রোগ্রামের ডিরেক্টর ইউন সান বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা মানেই সামগ্রিক অস্থিরতা, যা চীন (বাংলাদেশে) দেখতে চায় না। কারণ, এর ফলে দেশটিতে চীনা যত প্রকল্প আছে তাতে আরও অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।’
ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘চীন ঢাকায় পরবর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করা সহজ মনে করতে পারে। তবে অনিশ্চয়তার সময় কতটা বর্ধিত হবে—এই বিষয়টি চীনের জন্য উদ্বেগের বিষয় হতে পারে। বাংলাদেশে চীনের যে বিনিয়োগ, অন্যান্য স্বার্থ ও হিস্যা আছে সেগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই চীন এই অনিশ্চিত সময়কে বর্ধিত হতে দিতে পারে না।’
চীন-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৭৫ সালে। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেয় এবং এর ধারাবাহিকতায় চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের অনুমান, ২০০৫ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশে মোট ৭৫৬ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। চীন ২০১৯-২০ অর্থবছরের পর থেকে বাংলাদেশকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে।
চলতি বছরের মে মাসে চীন ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের প্রথম যৌথ সামরিক মহড়া চালায়। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া এই মহড়ার বিষয়ে বলেছিল, এই মহড়া দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও বন্ধুত্ব বাড়ানো এবং কৌশলগত বিনিময় ও সহযোগিতাকে গভীর করার জন্য সহায়ক হবে।
তবে চীন ও ভারতের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে হাসিনার প্রচেষ্টা চীনকে ক্ষুব্ধ করেছে। এমনকি বেইজিং বাংলাদেশে তাঁর বিনিয়োগ বাড়ালেও ঢাকা সোনাদিয়া দ্বীপে চীনের আগ্রহে তৈরি হতে যাওয়া গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। ভারত মহাসাগরে চীনের এই বন্দর প্রকল্পগুলো নয়া দিল্লির জন্য দীর্ঘদিনে উদ্বেগ।
অতি সম্প্রতি, হাসিনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ভারতের প্রস্তাব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে চীনকে ক্ষুব্ধ করেছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। এই প্রকল্পের জন্য চীন ১০০ কোটি ডলার প্রস্তাব করেছিল। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, চীনে শেষ সফরের সময় শেখ হাসিনা ৫ বিলিয়ন ডলার চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন এবং তিস্তা প্রকল্পে চীনকে না নেওয়াই এর কারণ।
একটা সময় মনে হয়েছিল যে, বাংলাদেশ চীন তার পায়ের তলার মাটি হারাচ্ছে। কিন্তু গত ৫ আগস্ট হাসিনার দেশ ছাড়ার পর চীনের জন্য আবারও সুযোগ তৈরি হয়েছে সবচেয়ে বড় ঋণদাতা ও বিনিয়োগকারী হিসেবে বাংলাদেশে আরও জোরালো ভূমিকা রাখার। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, জুন মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সহসভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু ঢাকা সফররত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান লিউ জিয়ানচাওয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
ইউন সান বলেন, ‘বাংলাদেশকে ঐতিহাসিকভাবেই ভারতীয় প্রভাব বলয়ের দেশ হিসেবে দেখা হয়। যদি (বাংলাদেশে) সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি এর ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় তবে আমি মনে করি না যে, চীন দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে সামগ্রিকভাবে পরাজিত হিসেবে বিবেচিত হবে।’
তবে যাই হোক, হাসিনার পতনে চীন খুব একটা খুশি হয়নি। কারণ, চীনের কাছে গণতন্ত্র নয়, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে একটি বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতায় আসার পর বেইজিং দৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীনভাবে সেই বিজয়কে সমর্থন করেছিল। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারকে নিন্দা করেছিল।
তবে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনের অবসান হয়েছে তা অবশ্যই চীনের জন্য স্পর্শকাতর। কারণ, ১৯৮৯ সালে চীনে মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতিসহ নানা ইস্যুতে ছাত্রদের আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশটির আলোচিত তিয়েনানমেন স্কয়ারে জমায়েত হয়েছিলেন লাখো ছাত্র-জনতা। চীন সরকার সেই আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করেছিল। ৩৫ বছর পরও বিষয়টি চীনা সমাজে একটি নিষিদ্ধ বিষয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চীনা সমাজে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে, উচ্চ বেকারত্ব থেকে শুরু করে সম্পত্তির সংকট যা অনেক পরিবারের সম্পদকে সংকুচিত করছে। বাংলাদেশের বিক্ষোভ তরুণ চীনাদের মাঝেও অনুরণিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সাংহাইয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, হাসিনা যখন পদত্যাগ করেন তখন তিনি এক ধরনের আনন্দ অনুভব করেছিলেন।
চীনা যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোতে অনেকেই বাংলাদেশের আন্দোলন সমর্থনে মন্তব্য করেছেন। তাদের কেউ কেউ এটিকে ‘জনগণের বিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। একজন লিখেছেন, ‘আমি সাহসী বাংলাদেশের জনগণকে স্যালুট জানাই।’ হ্যাংঝোভিত্তিক রাজনৈতিক গবেষক ওয়েন কেজিয়ান বলেন, ‘এ ধরনের কণ্ঠস্বর চীনা সমাজের মধ্যকার আবেগের বহিঃপ্রকাশ যা বাইরের ঘটনাকে সমর্থন করার মধ্য দিয়ে ঘটছে।
যাই হোক, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতন বাংলাদেশে চীনকে একটি ‘অস্বস্তিকর’ অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। তবে এত কিছুর পরও চীন বাংলাদেশে ভারতের তুলনায় অন্তত ভালো অবস্থানে আছে এবং হাসিনার পতন বাংলাদেশে চীনা স্বার্থকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করলেও দেশটির পক্ষে একটি নতুন অগ্রযাত্রার সুযোগ আছে।
No comments